তুরস্কের ভূমিকম্পের পর থেকেই জেঁকে বসা ব্যথাতুর এ নৈরাশ্যের মধ্যেই আশার আলো জ্বেলেছে কিছু অলৌকিক ঘটনা। গত সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) শেষ রাতের ৭.৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর ধ্বংসস্তূপের ভ্যাপসা অন্ধকারের নিচে চাপা পড়ে থাকা মা নেকলা কামুজ (৩৩) ও তার ১০ দিন বয়সি ছেলে ইয়াগিজের বেঁচে ফেরা গল্পের প্রতিটি শব্দেই ঝলকে উঠছে অবচেতন মনের সেই ‘অলৌকিক আলো’।

নেকলা ও তার পরিবার তুরস্কের হাতায় প্রদেশের সমন্দগ শহরের একটি আধুনিক পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় বসবাস করতেন। গত ২৭ জানুয়ারি নেকলা তার দ্বিতীয় ছেলের জন্ম দেন। নাম রাখেন ইয়াগিজ, যার অর্থ একজন সাহসী। সেখানে তারা নিরাপদেই ছিলেন। এর ঠিক ১০ দিন পর স্থানীয় সময় রাত ৪.১৭ মিনিটে ছেলেকে খাওয়াচ্ছিলেন। তখনই শুরু হয় বিধ্বংসী ভূমিকম্প।

নেকলা জানান, যখন ভূমিকম্প শুরু হয় তখন আমি স্বামীর কাছে যেতে চেয়েছিলাম, যিনি অন্য ঘরে ছিলেন। আমাদের আরেক ছেলেকে নিয়ে তিনিও আমার কাছে আসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তখনই কাপড় রাখার ওয়ারড্রবটি তাদের ওপর পড়ে যায়। তাই তারা আর নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। তিনি আরও বলেন, যত সময় যাচ্ছিল ঘরটি কাঁপছিল, দেওয়াল ধসে পড়ছিল। ভবনের অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছিল। যখন ভূমিকম্প থামে তখনো আমি বুঝতে পারিনি যে আমি ধ্বংসস্তূপের নিচে আছি। তখন আমি তাদের নাম ধরে চিৎকার করেছিলাম, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। নিজের দিকে তাকাতেই দেখেন তখনো তার দুধের শিশুকে আঁকড়ে রেখেছেন বুকে। একটি বড় ওয়ারড্রব তাদের কংক্রিটের স্ল্যাব থেকে থেঁতলে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে ছিল। মা-ছেলে প্রায় চারদিন ছিলেন ওই ধ্বংসস্তূপের আঁধারে।

প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা : ধ্বংসস্তূপের নিচে শুয়ে নেকলা ‘অন্ধকার’ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। কী ঘটছে তা বোঝার জন্য তাকে অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। তবে তার কাছে স্বস্তির বিষয় এটাই ছিল যে তিনি বুঝতে পারেন তার ছেলে ইয়াগিজ এখনো শ্বাস নিচ্ছে। কিন্তু ধুলোর কারণে প্রথমে তার শ্বাস নিতে কিছুটা সমস্যা হলেও পরে তা ঠিক হয়ে যায় বলে তিনি জানান। কারণ, ধ্বংসস্তূপের নিচে কিছুটা উষ্ণতা ছিল। ধ্বংসস্তূপের নিচে তিনি ওয়ারড্রব, তার পরনের কাপড় ও তার বাচ্চার কোমল ত্বক ছাড়া আর কিছু অনুভব করতে পারছিলেন না। দূর থেকে তিনি কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি চিৎকার করে তাদের ডাকার চেষ্টা করছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন কেউ না কেউ আছে। নেকলা ওয়ারড্রব ও কংক্রিটের টুকরা দিয়ে শব্দ করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি জানান, সেসময় তিনি আতঙ্কিত ছিলেন।

ভূগর্ভস্থ জীবন : অন্ধকার ও ধ্বংসস্তূপের নিচে নেকলা যেন সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেখানে তিনি ভাবতে থাকেন-জীবনটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের যখন একটি নতুন শিশু জন্ম নেয়, তখন কত স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিন্তু হঠাৎ যেন সব ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে গেল। তবুও তিনি জানতেন যে তাকে ইয়াগিজের দেখাশোনা করতে হবে। তিনি ইয়াগিজকে তার বুকের দুধ খাওয়াতে সক্ষম হন। কিন্তু তার নিজের খাবারের কোনো ব্যবস্থাই সেখানে ছিল না। ক্ষুধার জ্বালায় নিজেই নিজের বুকের দুধ খাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেন নেকলা।

ধ্বংসস্তূপের নিচে নেকলা ক্রমাগত তার পরিবারের কথা ভেবে গেছেন। তারা কোথায় আছে, কী করছে? তখন তিনি কিছু কণ্ঠস্বর ও পায়ের আওয়াজ শুনতে পান। কিন্তু সেগুলো ছিল অস্পষ্ট। নেকলা ভাবতে পারছিলেন না যে তিনি এখান থেকে বের হতে পারবেন। ইয়াগিজের উপস্থিতি সেসময় তাকে আশা জাগাত। সেখানে তিনি বেশির ভাগ সময় ঘুমাতেন। ঘুম থেকে জেগেই তার কান্না পেত-কাঁদতেন। বাচ্চাকে খাওয়াতেন।

পুনরুদ্ধার : মাটির নিচে ৯০ ঘণ্টারও বেশি সময় পরে নেকলা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনতে পান। কেউ একজন ডাকল-আপনি ঠিক আছেন? আপনার স্বামীকেও আমরা খুঁজে পেয়েছি। তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। নেকলা ভাবল-স্বপ্ন দেখছেন তিনি! উদ্ধারকারীরা তাকে উদ্ধারের জন্য অনেক সাবধানে ধ্বংসস্তূপ খনন করছিলেন। কারণ, তার কাছে ইয়াগিজ ছিল। একটু পরেই টর্চের আলো পড়ে সমস্ত অন্ধকার কেটে গেল। নেকলার মনে হচ্ছিল-তিনি যেন নতুন করে আরও একবার জীবন পেলেন। উদ্ধারকারী যখন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ইয়াগিজের বয়স কত?

নেকলা তখন নিশ্চিত হতে পারেননি। তিনি শুধু জানান ভূমিকম্পের ১০ দিন আগে ইয়াগিজের জন্ম হয়। উদ্ধারকারীরা দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তিনি জানতে পারেন তার অন্য ছেলেকেও উদ্ধার করা হয়েছে।